বিপদে বন্ধুত্বের পরিচয় দিলেন ফারাজ
হলি আর্টিজান বেকারির বাবুর্চি যখন বুঝতে পারেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারণ আছে, তিনি বন্দুকধারীদের এড়াতে শৌচাগারে গুটিসুটি বসে থাকেন। ওদিকে রেস্তোরাঁয় লোকদের বাছাই করা হচ্ছিল।
তরুণদের একজন বলে, ‘আপনাদের এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা বাঙালিদের মারব না, শুধু বিদেশিদের মারব।’ তখন সমীর বাড়ই মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখেন, ছয়-সাতটি মৃতদেহ পড়ে আছে, যাদের দৃশ্যত গুলি করার পর কুপিয়ে ফালি ফালি করা হয়েছে। এদের সবাইকে বিদেশিই মনে হচ্ছিল তাঁর।
বাড়ই বলেন, বন্দুকধারীরা চাচ্ছিল, তাদের কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন রাষ্ট্র হয়ে যায়। ওই ব্যক্তিদের হত্যা করার পর তারা রেস্তোরাঁর কর্মীদের ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক চালু করতে বলে। এরপর তারা খদ্দেরদের মুঠোফোন ব্যবহার করে নিহত ব্যক্তিদের ছবি পোস্ট করে।
রেস্তোরাঁর সে রাতটি যেন শেষই হতে চাচ্ছিল না। হলি আর্টিজান বেকারিতে ওই রাতে আসন সংরক্ষণ করেছিলেন ১৮ জন।
আর্জেন্টাইন বাবুর্চি দিয়েগো রসিনি বলেন, এক টেবিলে সাতজন ইতালীয় বন্ধু বসেছিলেন, আরেক টেবিলে তিন বা চারজন। কেউ একজন ইতালীয় পাস্তার অর্ডার দিলে রসিনি সবে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন। রাত পৌনে নয়টার দিকে ছয়-সাতজন তরুণ ভারী ব্যাগে অস্ত্রশস্ত্রসহ রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে। তাদের সঙ্গে গ্রেনেড ও লম্বা রাইফেলও ছিল। বাবুর্চি রসিনি পালিয়ে ছাদে চলে যান। িতনি শুনতে পান, বন্দুকধারীরা পালিয়ে থাকা লোকদের খুঁজছে আর ‘আল্লাহু আকবর’ হাঁক দিচ্ছে।
রসিনি আর্জেন্টাইন সংবাদ সংস্থা ‘ক্যানাল ৫’ নোটিসিয়াশকে বলেন, রেস্তোরাঁয় অনেক বিদেশি ছিলেন। আর সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদেরই খুঁজছিল বন্দুকধারী তরুেণরা।
বাবুর্চি সমীর বাড়ই বলেন, বিদেশিদের মারলেও তরুণেরা রেস্তোরাঁর কর্মী ও বাংলাদেশিদের সঙ্গে সব সময় নম্র আচরণ করেছে। তারা কর্মীদের বলে, বিদেশিরা স্বল্প কাপড় পরে, মদ পান করে। এরা ইসলামের প্রসারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক জঙ্গি বলে, ‘তাদের জীবনযাপন দেখে স্থানীয় মানুষজন তাদের অনুকরণ করতে উৎসাহিত হচ্ছে।’
জঙ্গিরা কর্মীদের বলে, বাকি জিম্মিদের যেন চা-কফি দেওয়া হয়। গত শনিবার ভোর সাড়ে তিনটার দিকে মুসলমানরা যখন সাহরি খান, তখন তারা কর্মীদের বলে, মাছ ও চিংড়ি রান্না করে তাঁদের যেন খাওয়ানো হয়। তরুণেরা শহুরে বাংলায় কথা বলছিল। অনেকে আবার বিদেশিদের সঙ্গে ইংরেজিতেও কথা বলছিল। সমীর বাড়ই বলেন, ‘হামলাকারীরা সবাই স্মার্ট, সুদর্শন ও সুশিক্ষিত। তাদের দিকে তাকালে কেউই বিশ্বাস করবে না যে তারা এ কাজ করতে পারে।’
সকালের দিকে বন্দুকধারীরা হিজাব পরা কয়েকজন নারীকে ছেড়ে দেয়। তারা এঁদের সঙ্গে ফারাজ হোসেন নামের এক বাংলাদেশি তরুণকেও ছেড়ে দিয়েছিল বলে জানান ফারাজের নিকটাত্মীয় হিশাম হোসেন। হিশাম ছাড়া পাওয়া এক জিম্মির কাছ থেকে ঘটনাটি শুনেছেন।
ফারাজ যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর সঙ্গে পশ্চিমা পোশাক পরা দুজন নারী ছিলেন। বন্দুকধারীরা নারীদের জিজ্ঞেস করেছিল, তাঁরা কোথা থেকে এসেছেন। জবাবে একজন ভারত ও একজন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার কথা জানান। শুনে বন্দুকধারীরা তাঁদের ছাড়তে রাজি হয়নি। তখন ফারাজও তাঁদের ফেলে রেখে বেরোতে অস্বীকৃতি জানান। শনিবার অন্য মৃতদেহের সঙ্গে ফারাজের মৃতদেহও পাওয়া যায়।
এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ জিম্মিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েও পারেনি, তারা আসলে কোনো দাবির কথা জানায়নি।
বন্দুকধারীরা আটজনকে শৌচাগারে আটকে রেখেছিল। সেখানে আটক সমীর বাড়ই রাত পৌনে দুইটার দিকে তাঁর এক জ্ঞাতি ভাইকে খুদে বার্তা পাঠান। ওই জ্ঞাতি ভাই তখন পুলিশের বেষ্টনীর বাইরে ছিলেন।
‘বাইরের কী অবস্থা?’ সমীর জানতে চাইলে জ্ঞাতি ভাই বলেন, ‘র্যা বের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট অভিযােন যুক্ত হয়েছে। তারা কিছু করছে না, যাতে তোমাদের ক্ষতি না হয়।’
ভোরের দিকে সমীর বাড়ইয়ের মনে হয়, অতটুকু জায়গায় দম বন্ধ হয়ে তাঁরা হয়তো মরেই যাবেন। ঘরটা চার ফুট বাই চার ফুট। তিনি লেখেন, ‘টয়লেটের ভেতরে টেকা দায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে এসো।’
খুব সকালে সামরিক অভিযানের অনুমতি দেন শেখ হাসিনা। সি-১৩০ হেলিকপ্টারে করে ১৫০ মাইল দূরের সিলেট শহর থেকে এক কমান্ডো দল উড়িয়ে আনা হয়। ডজন খানেক সাঁজোয়া যান রেস্তোরাঁর চারপাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে যায়।
প্রতিবেদনটি গত শনিবার প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস।
Post a Comment